এই তো সেদিন। দিনটির কথা এখনও চোখে ভাসছে। রৌদ্রের উত্তাপ নেই। শীতল বাতাস বইতেছে। প্রকৃতির নিস্তব্ধতা যেন স্বাগত জানাল তাকে এই অপরূপ সৌন্দর্য্যখচিত পৃথিবীতে। জন্ম হলো তার। ফুটফুটে নিষ্পাপ চেহারার অপূর্ব দেখতে। তার জ্যেতি যেন বাড়ির প্রতিটি কোনায় আলোকিত করে তুলল। সবার চোখে মুখে কি যে অনাবিল আনন্দের দীপ্তি ফুটে উঠল। তার মুখখানির দিকে চেয়ে থাকলাম অপলক দৃষ্টিতে। ভাবলাম বিধাতা কত সুন্দর করে নিজ হাতে আমাদের সৃষ্টিকর্মে দুনিয়াতে পাঠায় কিন্তু কালের প্রবাহে সেই সৌন্দর্য্যে লালিত জীবনের লাবণ্যটা বাস্তবতার বিশাল মরুভূমিতে মরীচিকার মতো চক-চক করে এক সময় কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়।
দোলনায় হাত-পা ছড়াছড়ি করে মায়ের মমতায় ও সকলের ভালবাসায় বড় হতে থাকল সে। হাটি-হাটি পা পা করে মা-বাবা ডাক শেখা যেন তার নিজের মাঝে আপন গতিতে চলা এক টুকরো আশার আলো উঁকি দিতে থাকে। যখনি একটু আধটু বুঝতে শেখা তখনি বাস্তবতার হাতছানি। বাড়ির উঠোনে খেলা করা, কবুতরগুলোকে তাড়াকরা, রাতে জোনাকির আলোর মাঝে ছুটে যাওয়া, চাঁদ মামাকে কাছে ডাকা মূহুর্তগুলো তার দুরন্ত মনকে নাড়া দিত না। শানত স্বভাবের মেয়েটি। সারাক্ষণ আপন ভুবনে নিজেকে বিচরণ করাত সে। নিজেকে বিকশিত করার মূহুর্ত এখন। কিন্তু সেই মূহুর্তগুলো যেন পিছন ফিরে কটাক্ষ করে তাকে বলছে আসবে তুমি এই ভুবনে!! আমাকে মামা বলে ডাকত সে। এমন মিষ্টি ডাক ঠিক যেমন ভোরের পাখিরা ঘুম ভাঙ্গাবার জন্য নরম সুরে গান করে তেমন। মনটি আনন্দে ভরে যেত। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জিনিসগুলোর সাথে অন্যভাবে পরিচিত হতে ব্যাকুল ছিল তার মন। কিন্তু পৃথিবীর আসল রূপ উপভোগ করার ও দুরন্ত প্রাণের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার আগেই এক কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে আপনাকে মিলিয়ে নিতে শেখা হলো তার।
তাকে পড়াতাম আমি। কারণ, আমার মাঝে মনে হয় তার পৃথিবীটাকে নতুন করে চেনার একটা পথ খুঁজে পেয়েছিল। তাই খুব কাছে থেকে তার অনাকাঙ্ক্ষিত মূহুর্তের ছাপ উপলব্ধি করেছি। পড়ানোর সময় ঠিকমতোই পড়াশুনা করত। অসাধারণ চৌকশ তার বুদ্ধিমত্তা। অদ্ভুত রকম প্রশ্ন করত সে। বলত, বাবা আমাকে খুব আদর করে মামা আমিও আমার পুতুলকে খুব আদর করি। বলতাম সব বাবারাই তো আদুরে সন্তানদের আদর করে। ক্লাসে প্রথম, বরাবরই রেজাল্ট ভাল, ছবি আঁকা থেকে শুরু করে গল্প বলা, অভিনয়, গান সবই যেন তার আয়তের মধ্যে। পুরষ্কারও পেল বলত, মামা যদি আমি সুন্দরভাবে কাজ করি তাহলে অনেক পুরষ্কার পাব তাইনা?
তার প্রশ্নের মাঝে কতকিছু ইঙ্গিত করে বুঝতামনা। তার ভেতরের পৃথিবীটা শুরুতেই থমকে গেছে। মনের ভেতর আনন্দ নামের পাখিটা ছট-ফট করছে। চারিপাশের রঙিন জিনিসগুলো কেমন তার কাছে বিবর্ণ।
তার এক সময় দুরন্ত ও একসময় শানত হতে দেখে মনে খটকা লাগত । অনেক চেষ্টার পর জানতে পারলাম, তারই সামনে তার মাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল তারই বাবা। সারাদিন বারান্দার পিলারে বাঁধা মায়ের আর্তনাদ শুনত সে। ঠিকমতো খাবার না পাওয়া শুকিয়ে থাকা মায়ের মুখখানি দেখে সে প্রতিদিন। এতটুকু মেয়ে এসব ঘটনা তার মনের মধ্যে ধৈর্যের সঙ্গে দিন-দিন জমে রেখেছে অথচ কোন বহিঃপ্রকাশ ঘটায়নি । নিজেই নিজের মাঝে কেমন করে কষ্টগুলোকে কবর দিয়ে আপন ভুবন তৈরিতে সচেষ্ট সে।
তার প্রশ্নগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়াত কিন্তু উত্তর খুঁজে পাইনা। শুধুই ভাবি, আমরা কি পারিনা এই সুন্দর নিষ্পাপ চারাগুলিকে বেড়ে ওঠার আনন্দঘন সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে দিতে? বাস্তবতার প্রকৃত স্বাদ পাওয়ার প্রসাদ বিলিয়ে দিতে?- যেমনটি চৈত্রের দুপুরে হঠাৎ মেঘে টিপটাপ বৃষ্টিতে চৌচির মাটি ফিরে পায় তার সিক্ত হওয়ার সুযোগ। আমাদের সৃষ্ট পাপে জরাজীর্ণ ধূলিময় পৃথিবীটাকে তাদের কাছ থেকে দূরে ছুড়ে ফেলতে? আমাদের কলুষময় জীবনটাকে তাদের স্বপ্নময় জীবনের কাছে না ভিড়তে দিতে? স্বল্প আলোয় নিজেদের কু-প্রবৃত্তিকে অন্ধকারে গলা টিপে সেখানেই মেরে ফেলতে? কেন তা একটি সুন্দর বাগানকে ভেঙ্গে চুরমার করবে?
বাবা-মা এর ডিভোর্স হয়েছে বছর দুই হয়েছে। মায়ের মমতাহীন জীবন কেটে গেছে দুইটি বছর। একদিন হঠাৎ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে সেই মামা ডাক। পেছন ফিরে দেখি বুকের মাঝে বয়ে যাওয়া হাজারো ঝড়ের মাঝে তার কৃত্রিম হাসিটুকু যেন কাল মেঘ ভেদ করে স্বসতির আলো উঁকি দিচ্ছে। একবার সে প্রশ্ন করেছিল রাতের বেলায় তারাগুলো সবসময় কি কাছাকাছি থাকে মামা? নিজেকে সামলিয়ে চোখের জলকে আটকাতে পারলামনা । কারণ তার কাছে শিখেছি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বাসতবতার কষাঘাতে সৃষ্ট অমানিষার অন্ধকারের বুক চিরে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হতে। আমাদের ভেতরের না দেখা এমনসব ঘটনা যা আমরা বাহির থেকে আঁচ করতে পারিনা। যা কখনও কখনও বৈশাখের ঝড়ের মত এক ঝটকায় মূহুর্তের মধ্যে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। তার মুখখানির দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, তুমি তো বাসতবতার অনলের শীর্ষভাগের নীলাভশিখা। সেই শিখা কি পারবে ভবিষ্যতের লালিত স্বপ্নগুলোকে খাঁটি করতে? না বিষাদের ঝড়ো হাওয়ায় সেগুলো অঙ্গার হয়ে একটা-একটা করে নিভে যাবে? বলল মামা আমি মায়ের সাথে দেখা করতে যাবো কাল।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।